বড়ভাই

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২১

দীপু মাহমুদ
আমার বড়ভাই আমার চেয়ে বয়সে বছর আড়াইয়ের বড়। ছোটোচাচা তার সমবয়সী। সে আর ছোটোচাচা একসঙ্গে খেলা করে। পাখির বাসায় ডিম আর বাচ্চা খুঁজে বেড়ায়। নদীর পাড়ে গর্তের মুখে সাপ দেখে দৌঁড় দেয়। ফিরে এসে বাগানে শেয়াল তাড়ায়। বর্ষায় টইটম্বুর খালে মাছ ধরতে যায়।

আমি বয়সে ছোটো তাই আমাকে নেয় না। আমার খেলার সাথি নেই। ওদের পেছন-পেছন ওপাড়াতে রওনা হই। তারা দুজন গলা ধরাধরি করে হাঁটে। পেছনে আমাকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। ‘এই, যা-যা’ করে আমাকে তাড়িয়ে দেয়। আমি কষ্টে কেঁদে ফেলি। বড়োভাইয়ের ওপর কঠিন রাগ নিয়ে বড়ো হতে থাকি।

সে আর আমি এক ইশকুলে পড়ি। ছোটোচাচা পড়ে অন্য ইশকুলে। ইশকুলে একসঙ্গে স্কাউটিং করি। স্কাউটস ক্যাম্প হয়। আমরা ক্যাম্পে যাই। ক্যাম্পে গেলে ব্যাজ দেয়। ব্যাজের প্রতি আমার তীব্র আগ্রহ। অনেক ব্যাজ জমিয়ে গাউন বানানোর ইচ্ছে। গাজীপুর মৌচাকে জাম্বুরি হচ্ছে। বিশাল আয়োজন। আমার আসা হলো না। পড়াশোনা ছিল। ভাই এলো। প্রত্যেককে একটা করে ব্যাজ দিয়েছে। অতিরিক্ত ব্যাজ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমার জন্য জাম্বুরির ব্যাজ জোগাড়ের সন্ধান করতে থাকল ভাই। ব্যাজ জোগাড় হলো না। মৌচাক থেকে চিঠি লিখেছে। তাতে লিখেছে, “তুই মন খারাপ করিস না। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। যদি ব্যাজ জোগাড় করতে না পারি তাহলে আমার ব্যাজটা তোকে দিয়ে দেব।” জাম্বুরি থেকে ফেরার আগেরদিন ভাই আমার জন্য ব্যাজ জোগাড় করে ফেলল। আমার জন্য সেটা ছিল এক হীরকখণ্ড।

আমার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আকাশে বাতাসে আনন্দ ছড়ানো ভয়াবহ রকমের ভালো ফল। জেলা শহর থেকে গ্রামে যাব দাদার সঙ্গে দেখা করতে। বাসে চড়ে যেতে হয় অনেকখানি পথ। তারপর মাটির রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে ১২ মাইল। অতটা পথ আমি একা যেতে পারব না। ভাই বাসের মাথায় সাইকেল চাপিয়ে আমার সঙ্গে রওনা হলো। বাস থেকে নামার পর শুরু হলো আমাদের মূল যাত্রা।

বর্ষাকাল। ঘনঘোর বর্ষা। ঘোড়ার গাড়ি আর গোরুর গাড়ি চলে রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা বানিয়ে ফেলেছে। সেখানে সাইকেল চালানো যায় না। তখন আমার স্রোতস্বিনী আনন্দ। রাজহাঁসের বুকের পালকের মতো হালকা আমি। লাফিয়ে লাফিয়ে পথ পেরুচ্ছি। ভাই সাইকেল নিয়ে পথ পেরুতে পারছে না। কাদার ভেতর সাইকেল ধাক্কাচ্ছে। খানিকদূর গিয়ে আখের চোঁচা দিয়ে সাইকেলের চাকায় আটকে যাওয়া কাদা ছুটিয়ে আবার এগুচ্ছে। রাস্তার পাশে বসে থাকা বর্ষাদিনের অলস মানুষের টিপ্পনীকাটা পরামর্শ সহ্য করছে। দিনের সূর্য পশ্চিমে হেলছে। সাইকেল কাঁধে নিয়ে ভাই একহাঁটু কাদা মাড়িয়ে দরদর করে ঘামছে আর এগিয়ে যাচ্ছে। মুখে অদ্ভুত ভালোলাগা প্রশান্তি।