দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেনো সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে অসংখ্য গালিচা। না, এটি ‘কান’ উৎসবের লাল গালিচা নয়। এটি ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় ঝাল মরিচের লাল গালিচার গল্প। উপর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই এগুলো লাল গালিচা কি না। তবে কাছে গেলেই বোঝা যায় আসলে এগুলো পাকার মরিচ। যা স্থানীয় কৃষকরা শুকাতে দিয়েছে রেল লাইনের ধার ঘেষে।
এ দৃশ্য ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া রেলস্টেশন এলাকার। মরিচ শুকিয়ে বাজারজাত করলে বাড়তি দাম পাওয়া যায়। তাই প্রতিদিন ভোরে বস্তায় বস্তায় পাকা মরিচ রেললাইনের ধারে নিয়ে আসেন কিষাণ কিষাণীরা। রেললাইনের দুই পাশে ও পাটাতনের মাঝখানে পাটি, মাদুর, পলেথিন বিছিয়ে মরিচ শুকাতে দেন। পরে সম্পুর্ন শুকানো হলে প্রক্রিয়াজাত ও মাপজোক শেষে সেসব মরিচ যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
আবহাওয়া অনুক’লে থাকায় এবার ঠাকুরগাঁওয়ে মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতোমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে পাকা ও শুকনো মরিচ। তাই স্থানীয় হাট বাজার গুলোতে ভীর জমাতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ীরা। ফলে মরিচের দাম ভালো পেয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে জেলায় মোট ২ হাজার ২শ ২৩ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। যা থেকে প্রায় ১শ ৭৩ কোটি টাকার শুকনা মরিচ উৎপাদিত ও রপ্তানি করা হবে। উৎপাদিত এসব মরিচের মধ্যে দেশি প্রজাতি সহ রয়েছে বাঁশ গাইয়া, জিরা, মল্লিকা, বিন্দু, হটমাস্টারসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের মরিচ ।
রুহিয়ায় রেললাইনের পাশে কথা হয় চাষি জমিরুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, কাঁচা অবস্থায় মরিচের দাম কম থাকে। এ কারণে শুকিয়ে বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক নিয়ে এখানে মরিচ কিনতে আসেন ব্যবসায়ীরা। সে সময় স্টেশন এলাকা কর্মচঞ্চল থাকে।
কথা হয় লিয়াকত আলী নামের আরেক কৃষকের সাথে। তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে বিন্দু ও বাঁশগাড়া জাতের মরিচ আবাদ করেছেন। নিড়ানী, সেচ ও পরিচর্যা পর্যন্ত তার ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর ওই জমিতে মরিচ উৎপাদন হয়েছে কমপক্ষে ১০ মণ। এবার প্রতি মণ মরিচ ১৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি করে বিঘাপ্রতি প্রায় দেড় লাখ টাকা পাওয়া যাবে।
সদরের ভাওলারহাট এলাকার কৃষক শাহীন আলম বলেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় মরিচের ফলন আশানুরুপ হয়েছে। দামও পাওয়া যাচ্ছে ভালো। এ রেল গেইট এলাকার প্রায় ৭০ ভাগ কৃষকই মরিচ চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পৌষ মাসে মরিচের চারা রোপণ করার পর থেকে মরিচ উৎপাদন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। বিন্দু, সেকা, মাশকারা, মল্লিকা সহ বিভিন্ন জাতের মরিচ চাষ হয় এই এলাকায়। তিনি বলেন, আমি ২ বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি, এতে ১ লাখ টাকা খরচ হলেও লাভ থাকবে আরো প্রায় ৩ লাখ টাকা।
পাশের এলাকার স্বামীর সঙ্গে মরিচ শুকাতে আসা মেরিনা বেগম বলেন, ১৫ কাঠা জমিতে মরিচ চাষ করেছি, মরিচের চারা রোপণ, সার-বিষ, রোদে শুকানো সহ সব কাজ নিজেরাই করি, গতবারের তুলনায় এবার অনেক ভালো মরিচ হয়েছে, এবারে মরিচ নষ্ট হয়নি, মরিচের দামও বেশ ভালো, আমরা সবাই এবার খুশি।
মরিচ কিনতে আসা ব্যবসায়ী মজিবর রহমান বলেন, এ জেলার মরিচের আকার, বর্ণ ও স্বাদের কারণে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ স্টেশন এলাকা থেকে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মরিচ কেনাবেচা হয়। এলাকার ৭০ ভাগ কৃষকই মরিচ চাষের সঙ্গে জড়িত।
রেললাইনের ধারে মরিচ শুকাতে এসেছিলেন স্থানীয় কৃষক সারোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, প্রতি বিঘায় এখন পর্যšন্ত ১০ থেকে ১২ মণ করে ফলন পেয়েছেন। এবার মরিচের বাজারও ভালো। প্রতি মণ মরিচ ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বিঘায় চাষে খরচ হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে বিঘাপ্রতি ভালো লাভ থাকবে।
স্টেশন এলাকা থেকে কিছুটা দক্ষিণে রুহিয়া কুজিশহর, আসানগড়সহ জেলার হরিপুর, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার ইউনিয়ন। এসব এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠে গ্রীষ্মকালীন মরিচ চাষ হয়েছে। গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে কাঁচা-পাকা মরিচ। খেত থেকে তুলে পাকা মরিচ রোদে শুকাতে ব্যস্ত চাষীরা । তাদের বাড়ির উঠানজুড়ে মরিচের ঝাঁজালো ঘ্রাণ।
এদিকে, খেতে মরিচ সংগ্রহ কাজে শিশু-কিশোর পাশাপাশি পরিবারের বয়স্ক সদস্যরাও এতে যোগ দেন। প্রতিটি মরিচের ঝুড়ি ভর্তি হলে ২৫ থেকে ৩০ টাকা হিসেবে দিনে আয় করছেন কমপক্ষে ২শ’ থেকে ২৫০ টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মরিচের ফলন ভালো হয়েছে। গত বছর ও তার আগেও বৃষ্টির কারনে কৃষকরার তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। তবে এবার বৃষ্টি না থাকায় এবং ফলন ভালো হওয়ায় বিগত সময়ের লোকসান তারা কাটিয়ে উঠতে পারেবেন বলে আমরা মনে করছি।