পশ্চিমবঙ্গের একটি আদিবাসী পরিবারকে ডাইনি বলে ঘরছাড়া করা হয় করোনাভাইরাস মহামারির আগে। এরপর কেটে গেছে প্রায় তিন বছর। আজও নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেননি তারা। থাকছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। সেখানেও স্বস্তি নেই। ডাইনি বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন আত্মীয়রাও। ঘরছাড়া ১২ সদস্যের ওই পরিবারে বয়স্ক থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর এবং নারীরাও রয়েছেন।
বীরভূম জেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের কাছেই মণিকুণ্ডডাঙ্গার এক আদিবাসী পরিবারের অভিযোগ, তারা স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও ঘরে ফিরতে পারেননি।
ছাগল মারা যাওয়ায় ডাইনি অপবাদ
মণিকুণ্ডডাঙ্গার বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের যশোমতী হাঁসদাকে তার প্রতিবেশীরাই ডাইনি সাজিয়ে ঘরছাড়া করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত মঙ্গলবার যশোমতী জানান, গ্রামে একটি ছাগল মারা গেছিল। সর্দার রটিয়ে দিল, আমিই নাকি ছাগলটা খেয়েছি। আমাকে ডাইনি সাজিয়ে দিল। আমার বাড়িতেও বিপদ ছিল তখন। কেউ বুঝল না আমার বিপদ, ডাইনি সাজিয়ে দিল।
স্বামী, তিন ছেলে, পুত্রবধূ আর দুই শিশু-কিশোর নাতি-নাতনি নিয়ে তাদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে যারা, তারাও আদিবাসী সমাজেরই মানুষ।
যশোমতীর ছেলে উদয় হাঁসদার কথায়, মা পূজা করতো। তাই ঠাকুরতলায় পান, পাতা এসব পড়েছিল। মা-ই নাকি পাতা, পান ছড়িয়ে রেখেছিল আর তার জন্যই নাকি গ্রামে হাঁস, মুরগি, ছাগল সব মরে যাচ্ছে। তারা সন্দেহ করছে, কাজটা নাকি মা করেছে।
উদয় বলেন, পাঁচটি গ্রামের লোক মিলে খুঁজে বের করে মাকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করে। ঠাকুরতলা থেকে নাকি তারা সবাই শুনে এসেছে, মা ডাইনি। পান পাতাতে সিঁদুর দিয়ে নাকি আমার মা গ্রামের চৌমাথায় ফেলে এসেছিল।
তাড়িয়ে দিয়েছে আত্মীয়রাও
গ্রামছাড়া হওয়ার পরে হাঁসদা পরিবার আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেই থাকছিল ঘুরে ঘুরে। কিন্তু সেখানেও ডাইনি বদনাম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর গ্রামবাসীর ভয়ে আত্মীয়রাও তাড়িয়ে দিয়েছে পরিবারটিকে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য মেলানি হাসঁদার কথায়, যেখানে যার বাড়িতে গেছি, সেখানেও রটিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের ডাইনি অপবাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি আমার নিজের ভাইও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাকেও বলেছে, তোমার দিদির দুটো মেয়েকে বাড়িতে রেখেছো, ওরাও তো ডাইনি! গ্রামের লোকের চাপে ভাইও আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। তারপরে আমার বোনের বাড়িতে থাকি।
তিনি বলেন, এভাবেই ঘুরে ঘুরে তিন বছর কেটে গেল। বাচ্চাগুলো স্কুলে পড়তো। তারা এখন আর স্কুলে যেতে পারে না, পড়াশোনা করতে পারে না ঠিকমতো।
পরিবারটি বলছে, তারা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে কোনোমতে খেয়ে পরে বেঁচে রয়েছে।
জমি থেকে উৎখাতের চেষ্টা?
বীরভূমে আদিবাসীদের মধ্যে প্রায় আড়াই দশক ধরে কাজ করেন সমাজকর্মী কুনাল দেব। তিনি বলেন, মনিকুণ্ডডাঙ্গার ঘটনায় দুটি বিষয় জড়িত। প্রথমত, যাকে ডাইনি অপবাদ দেওয়া হয়েছে, সেই যশোমতী হাঁসদা গ্রামের ঠাকুরতলায় পূজা করতেন। স্থানীয় এক প্রভাবশালীর দুই আত্মীয়ও পূজার কাজ শুরু করেছিলেন। যশোমতীর কারণে তাদের পসার জমাতে সমস্যা হচ্ছিল বলে একটা পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো হয়। আবার এই পরিবারটি এক মালিকের বড়সড় মাপের জমিতে ভাগচাষী হিসেবে কাজ করতেন। ভাগচাষীদের সরিয়ে দিতে পারলে জমিটা কম খরচে বিক্রি করে দেওয়া যাবে।
কুনালের মতে, জমি ও ঠাকুরতলার পূজা- এই দুটো কারণেই স্থানীয় প্রভাবশালীরা হাঁসদা পরিবারকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। তবে এটি বীরভূমে বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ওখানকার জমি মূলত এক ফসলী। তাই জমির জন্য ডাইনি অপবাদ দিয়ে গ্রামছাড়া করার উদাহরণ খুব বেশি দেখা যায় না। আবার গ্রাম থেকে শুধু না, আত্মীয়-স্বজনদের এলাকায় গিয়েও অপপ্রচার চালিয়ে এলাকাছাড়া করা হবে, এমনটা সাধারণত দেখা যায় না। আসলে বোলপুর শহর লাগোয়া অঞ্চলে জমি হাঙ্গরদের দৌরাত্ম এতটাই বেড়ে গেছে, তথাকথিত উন্নয়নমূলক প্রকল্প, হোটেল, রিসোর্ট ইত্যাদির ফলে, তাই যেকোনো জমিই এখন বহুমূল্য হয়ে উঠেছে।
তবে ইতিহাস বলছে, জমি থেকে হটাতেই সবচেয়ে বেশি ডাইনি অপবাদ দেওয়ার চল রয়েছে। ‘সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান’-এর প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেন এ সমাজকর্মী।
বাসস্থান ও ক্ষতিপূরণের দাবি
হাঁসদা পরিবার জানায়, গ্রাম থেকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার পরেই তারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পুলিশের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো সহায়তা পায়নি।
প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তারা যোগাযোগ করে তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা শ্রেণি ও সংখ্যালঘুদের জন্য ‘জয়েন্ট ফোরাম’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে। তারাই গত সোমবার বোলপুরের মহকুমা প্রশাসকের কাছে হাঁসদা পরিবারকে নিয়ে ধর্না দিতে গিয়েছিল।
সংগঠনটির সভাপতি বৈদ্যনাথ দাশ বলেন, প্রায় ছয়মাস ধরে আমরা এই পরিবারটিকে গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা চাই, এরা যেভাবে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে থাকছে, সেখান থেকেও বিতাড়িত হচ্ছে, তার বদলে প্রশাসন এদের অস্থায়ীভাবে একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করুক। তিন বছর ধরে এদের কোনো আয় নেই। আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছে। প্রশাসন সেই ধারদেনাটার অর্থটা ক্ষতিপূরণ হিসেবে মিটিয়ে দিক।
প্রশাসন কী বলছে?
সোমবার রাত থেকে অবশ্য হাঁসদা পরিবারের ১২ জন সদস্যকে একটা কমিউনিটি হলে রাখার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। বীরভূমের জেলাশাসক বিধান চন্দ্র রায় বলেন, পরিবারটিকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে যে তিন বছর বাড়িছাড়া করা হয়েছে, ঘটনাটি আমি জানি। আমরা হয়তো প্রশাসনিক জোর খাটিয়ে তাদের গ্রামে ফিরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু গ্রামে এদের নিয়ে একটি ক্ষোভ রয়েছে। আমরা কতদিন আর পুলিশ পাহারায় রাখবো। তাই যদি জোর করে ফেরত দিয়ে আসি, তাহলে এই পরিবারটিকেই আরও বিপদের মুখে ফেলা হবে। আমরা সেটা চাই না।
তিনি বলেন, গ্রামের সব পক্ষকে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি, যেন তারা নিজেরাই পরিবারটিকে ফিরিয়ে নেয়। একইসঙ্গে, ওই এলাকায় আমরা সচেতনতামূলক প্রচারও চালাচ্ছি ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে। সেটিও আমাদের পরিকল্পনার অংশ। সব ধরনের চেষ্টা করছি যেন পরিবারটিকে দ্রুত গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। সুত্র-জাগোনিউজ২৪ ডট কম