২০২০ সালের ৩১ মার্চ। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। ওই দিনে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান একজন স্বপ্নবাজ প্রধান শিক্ষক। যাঁর ইচ্ছে ছিল শিক্ষার মান উন্নয়নে অবদান রাখাসহ তাঁর স্কুলটিকে মডেল স্কুল হিসেবে গড়ে তোলা।
ওই প্রধান শিক্ষকের নাম লুৎফা বেগম। তিনি ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শহর থেকে বেশ কিছু দূরে ছিল তাঁর সেই স্কুল। তাঁর বাড়ি যদিও শহরে ছিল কিন্তু গ্রামের সেই স্কুলে নিয়মিত সময়েই পৌঁছাতেন।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্কুলটির দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি স্কুলটির শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ শুরু করেছিলেন। হয়তো তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ঝরে পরা শিক্ষার্থী কমিয়ে আনার, শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে তিনি হয়তো কিছুটা করতেও পেরেছিলেন। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর হয়তো স্বপ্নের মাত্রাটা তাঁর একটু বেড়ে ছিল। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক চাইলেই স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর করা, শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে পথ দেখানোসহ নানা ভূমিকা রাখতে । এই স্বপ্নবাজ শিক্ষক তাঁর অনেক স্বপ্নই বাস্তবে রূপ দিয়ে যেতে পারেন নি।
এই স্বপ্নবাজ প্রধান শিক্ষকের জীবনসঙ্গীও আরেক স্বপ্নবাজ মানুষ। যিনিও তাঁর মতোই স্বপ্ন দেখেন এই সমাজ নিয়ে, সমাজের সাধারণ মানুষ নিয়ে। প্রধান শিক্ষক লুৎফা বেগমের জীবনসঙ্গী একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তাঁর নাম জয়নাল আবেদীন বাবুল। দীর্ঘ বছর ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঠাকুরগাঁও জেলার প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে ধরছেন তিনি। সমাজের নানা ক্ষেত্রে তিনিও অবদান রেখে চলেছেন।
প্রধান শিক্ষক লুৎফা বেগম ও সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন বাবুল দুজন মানুষই আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন।
এর আগে এক লেখাতেও সেটি লিখেছিলাম। সেটিরই কিছুটা সংস্কার করে নিচে আবারও লিখছি।
প্রধান শিক্ষককে আমি ‘আন্টি’ বলে সম্বোধন করতাম। পীরগঞ্জে থাকাকালীন সময়ে যখন সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়লাম। আর সাংবাদিক বাবুল আঙ্কেলের সঙ্গে যখন সম্পর্কটা আরও গভীর হয়ে উঠল তখন থেকেই পরিচয়। ২০১৪ সাল থেকেই তাঁকে চিনতাম। তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ দিতো। আমাকে আন্টি ‘হৃদয় বাবু’ বলে ডাকতেন। দেখা হলে বলতেন, ‘হৃদয় বাবু, পড়াশোনা কেমন চলছে?’।
এরপর আমি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার জন্য পীরগঞ্জ ছেড়ে ঢাকাতে যখন চলে আসলাম। বাড়িতে গেলে আঙ্কেলের সাথে তাদের বাড়িতে যেতাম। আমাকে ছেলের মতোই আদর করতেন। অনেক সময় সুখবর দিতেন। লাবণ্য (আঙ্কেলের বড় ছেলে) ক্লাস এইটে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। সেই খুশির খবর আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন।
কিছুদিন আগেও হঠাৎ করেই অফিসিয়ালি কোন বিষয়ে ঢাকাতে এসেছিলেন আঙ্কেলসহ। কাজ শেষ করে বিকালের দিকে আঙ্কেল ফোন দিয়ে বললেন,‘‘তোমার আন্টিসহ তো আমি ঢাকাতে।’’ আমি তখন অফিসে। বললাম, ‘আমি আসতেছি।’
পরে রাহবার বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখা হলো। আন্টি আঙ্কেলকে বললেন,‘হৃদয়কে কিছু খাওয়াও।’’ আঙ্কেল তখন আন্টিকে বললেন,‘হৃদয়,এখন চাকরি করে। সেই আমাদের খাওয়াবে।’’ এরপর গল্প করতে করতে বাস চলে এলো। আমি তাদের বাসে তুলে দিলাম। আন্টিকে আর খাওয়ানো হলো না!
ফেইসবুকে আন্টি আমার সাথে যুক্ত ছিলেন। আমি তাঁর স্কুলের নানা কর্মকান্ডের ছবিও দেখতাম। স্কুলের ওয়াশ ব্লক উদ্বোধন। তারপর স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য মিড ডে মিল চালু করলেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসও তিনি ছোট্ট পরিসরে হলেও আয়োজন করতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে জন্ম শতবার্ষিকী পালনের জন্যও তিনি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন স্কুলে। যদিও সেই অনুষ্ঠান করোনাভাইরাসের কারণে স্থগিত হয়।
স্কুলটি নিয়ে হয়তোবা তাঁর আরও স্বপ্ন ছিল। তিনি স্বপ্নের সবগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলেন না। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে গেল। এমন অসময়ে চলে যাবেন ভাবতেও পারি নি।
আমার পড়াশোনা শেষ। সাংবাদিকতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষও হয়ে গেল। আন্টি জানলে অনেক খুশি হতেন। হয়তো ওপার থেকেই তিনি জানতে পেরে খুশিও হয়েছেন।
আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি আন্টি।