অ্যাডভোকেট আবু সায়েম:
- কমরেড মনসুরুল আলম একজন চারন কমিউনিস্ট নেতার নাম। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ -রানীশংকৈল উপজেলার ভূমিহীন ক্ষেতমজুর, গরীব, কৃষক, শ্রমিক মেহনতী মানুষের কাছে যিনি নেতা মনসুর নামে একনামে পরিচিত। জনগন শুধু তাকে নেতা উপাধীতেই ভূষিত করেননি তার বাড়ির পার্শ্বে যে চৌরাস্তা তার নামও দিয়েছেন নেতার মোড়। পীরগঞ্জ ও তার আশেপাশের এলাকার লোকজনের কাছে নেতার মোড় আজ একটি অত্যন্ত পরিচিত এলাকা। সদা হাস্যজ্বল হাস্যরস ও কৌতুক প্রিয় কমরেড মনসুরের জীবনাচারনটাই ছিল আর দশ জন কমিউনিস্টর নেতার থেকে একটু অন্যরকম।
- অনেক বড় মাপের একজন নেতা হয়েও গায়ে একটা শার্ট বা ফতুয়া পরনে লুঙ্গি আর সঙ্গে একখানা ভাঙ্গা সাইকেল নিয়ে নিরঅহংকার নির্লোভ এই কমিউনিস্ট নেতা যেভাবে দশকের পর দশক গ্রামে-গঞ্জে পাড়া-মহল্লায় হাটে-বাজারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে বিচরন করে বেড়িয়েছেন সেটাই তাকে জনপ্রিয়তার চরম শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। মানুষের সুখ-দুঃখ বিপদ-আপদের পরম আস্থার জায়গাছিলেন কমরেড মনসুর। কখনই কোন মেম্বার চেয়ারম্যান এমপি মন্ত্রি না হতে পারলেও সৎ আদর্শবান রাজনিতীক নেতা হিসাবে ডিসি, এসপি, ইউ এন ও, ওসি, আর এম ও, টি এইচ ও বিভিন্ন অফিস আদালতে কর্মকর্তাদের কাছে তার গ্রহনযোগ্যতা ছিল অন্যরকম। তার একটা ছোট্ট চিরকুট বা একটা টেলিফোনে গরীব মেহনতী মানুষের অনেক বড় বড় কাজ হয়ে যেত। কথিত আছে কমরেড মানুষকে যদি তার ঝুলন্ত লুঙ্গিটা একবার হাতে ধরানো যায় তাহলে ধরে নিতে হবে তার কাজ হয়ে গেছে। আর সাইকেলের পিছনে চড়িয়ে যদি কোন কাজে কোন অফিসে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে সেই কাজ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার তার রেকর্ড নাই।
- কি মুসলিম কি হিন্দু আদিবাসী না বাঙ্গালী সোজা ঢুকে পরতেন তার বাড়িতে বসে পরতেন চট অথবা মাদুরে। খুব মজা পেতেন মুড়ি আর বিড়ির আপ্যায়নে। কৌতুক গল্প আর হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়েই সেরে ফেলতেন পার্টির কাজ। একটা মজার গুন ছিল তার গল্প আর বক্তৃতা করতেন হাস্যরস ব্যাঙ্গ আর কৌতুকের ছলে। যার ফলে সে কোথাও বসলেই বিশাল মজমা জমে যেত। জাতীয় রাজনীতির সমস্যাগুলোকে সে নিজের মত করে কৌতুক বানিয়ে হাস্যরস মিশিয়ে উপস্থাপন করতেন মানুষের সামনে। কৌতুক ছাড়া কখনই সে বক্তৃতা করত না। রাজনীতিই ছিল তার পেশা ও নেশা। ১৯৫৬ সালে ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার মধ্যে দিয়ে যে রাজনীতিক জীবন শুরু করেছিলেন যা ২০১৯ সালের ১১ মে রাত ১০ টার আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দীর্ঘ ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১ সেকেন্ডের জন্য কখনো বিচ্যুত হননি ন্যায়, নীতি, আদর্শ ও শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াই সংগ্রাম থেকে। তার হাতে গড়া অনেক রাজনৈতিক নেতা নীতি আদর্শ ত্যাগ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের বড় বড় নেতা হয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার জন্য সমাজতন্ত্রের জন্য শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। তাঁর সংগ্রামী নেতৃত্বের কারণে পীরগঞ্জের কয়েকশ ভূমিহীন পরিবার প্রায় ১০০০ হাজার বিঘা খাস জমি পেয়ে স্বচ্ছল জীবন যাপন করছে।
১৯৫৪ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়াকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ-এর এমপি নিবার্চনে স্বত্বঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহন করার মধ্য দিয়ে রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন সংগ্রামী এই জননেতা। ১৯৫৬ সালে ৮ম শ্রেনীতে পড়ার সময় দিনাজপুর জেলার ছাত্রনেতা হাসান আলী, মান্নান, নাসিম প্রমুখ নেতাদের হাত ধরে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হন। ৬২ ও ৬৬ এর আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে। ১৯৬১ সালে কুড়িগ্রাম রইসি হোমিও প্যাথী ম্যাডিকেলে ভর্তি হলেও ছাত্র রাজনীতির কারণে পড়াশুনা শেষ করেননি সেখানে। পড়ে ৬৬ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে তিনি আই কম প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের দিনাজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্র রাজনীতি শেষ করে ১৯৬৮ সালে কৃষক সমিতির সদস্য হয়ে পীরগঞ্জ এসে কমরেড মনসুর কৃষক সমিতির কাজ শুরু করেন। সেই সময় তিনি সঙ্গী হিসেবে পান পীরগঞ্জের ৯নং সেনগাঁও ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মকসেদ আলী, বীরহলী গ্রামের ইয়াসিন, ঘিডোবের শামসুল মেম্বার, পালিগাঁও এর আকবর আলী ও জনগাঁও গ্রামের জনৈক এক কৃষক নেতাকে। ছাত্র রাজনীতি করা কালীন সময়ে তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের আবুল কাশেম সরদার এর মাধ্যমে পার্র্টির প্রকাশনা শিখা ও অনন্যা প্রকাশনার বিভিন্ন প্রকাশনা পড়ে ধীরে ধীরে কমরেড মনসুর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬৯ সালে ন্যাপ নেতা ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক, ডাঃ মালেক, আওয়ামীলীগ নেতা মালগাঁওয়ের ইসমাইল উদ্দিন চৌধুরী, মালঞ্চার ডাঃ মোবারক আলী, পালিগাঁওয়ের সাবেক এমপি মখলেছুর রহমান, বীরহলির এনায়েতুল্লাহ, রিয়াজ মহাজন, শাহাজান, শওকত, আব্দুস সামাদ প্রমুখদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কমরেড মনসুর গণ অভ্যূখানের নেতৃত্ব দেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে কমরেড মনসুর সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করেন। ১৭ এপ্রিল পীরগঞ্জে পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমনের আগের দিন কমরেড মনসুর স্বপরিবারে পঞ্চগড়ে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকের কাজ করেন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া দিয়ে তিনি ভারতের আসামের তেজপুরে অবস্থিত ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গ্যারিলা ট্রেনিং ক্যা¤েপ গ্যারিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন কমরেড মনসুর। সেখানে তার সাথে ট্রেনিং করেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পীরগঞ্জের ভেবড়া গ্রামের নাজিম মাস্টার, সেনগাঁও গ্রামের ওসমান গনিকে। ১২-১৫ দিন ট্রেনিং করার পর যোগদান করেন লক্ষীরহাট ক্যাম্পে। ঐ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন ঠাকুরগাঁও এর গড়েয়া হাটের বাসিন্দা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা খাজা নাজিম উদ্দিন। ঐ ক্যাম্পের অপারেশন টিমের সদস্য ছিলেন কমরেড মনসুর। দায়িত্ব ছিল গোপনে পিস কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পে খবর দেওয়ার। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হলে পীরগঞ্জে ফিরে এসে কমরেড মনসুর দেশ পূর্নগঠনের কাজ শুরু করেন। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এলাকা ও শিবিরগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নিয়ে সেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। ১৯৭২ সালে পার্টির পুর্নাঙ্গ সদস্য পদ লাভ করার পর পীরগঞ্জ থানার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান কমরেড মনসুর। তখন পর্টির সদস্য নুরুজ্জামান, রমেশ মাস্টার, সাজেন মহেশ, তফিকুল, আজাদ, রিয়াজুল, ওয়াজেদ আলী সরকার, গোপাল, শচীন ডাক্তার প্রমুখদের নিয়ে পীরগঞ্জে পার্টি গঠনের কাজ শুরু করেন। সেই সময় ঠাকুরগাঁও মহকুমার নেতা ছিলেন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম কামু, কমরেড আলা ———————————— প্রমুখ।
রিলিফ চুরি, কৃষকের ডিজেল, সার-বিষের দাবি, ভূমিহীনদের খাসজমি বরাদ্দ দেওয়ার দাবি, ইত্যাদি বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, এসডিও, ইউএনও অফিস ঘেড়াও, ইউপি চেয়ারম্যানদের ঘেড়াও, মঙ্গাপিড়িত মানুষদের নিয়ে ভুখা মিছিল ও ইত্যাদি আন্দোলন সংগ্রামের কারণে এলাকায় চরম জনপ্রিয়তা পায় কমিউনিস্ট পার্টি ও কমরেড মনসুর।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করার জন্য কমরেড মনসুর, মুক্তিযোদ্ধা আনছারুল আলম ময়না, আব্দুল আজিজ, কশিরুল আলমসহ আরও একজনকে ট্রাবল মামলা আইনে পুলিশ পীরগঞ্জ থানায় ২৬ দিন আটক করে রাখে। এছাড়াও আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হতে হয়েছে কমরেড মনসুর কে। মাথায় হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে দীর্ঘদিন। ১৯৮১ সালে পার্টির প্রশিক্ষন নিতে বুলগেরিয়া যান কমরেড মনসুর। সেখানে ১ বছর পার্টির প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। ৮০ এর দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পার্টির আন্দোলন সংগ্রামের কারণে পার্টির অনেক জাতীয় নেতা কমরেড মনসুরের বাড়িতে আসতেন এবং থাকতেন। কমরেড মণি সিংহ, তার স্ত্রী অনিমা সিংহ, বারিন দত্ত (সালাম ভাই), কমরেড মানিক, নুরুল ইসলাম নাহিদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কৃষক নেতা খয়ের আলী, সৈয়দ আবু জাফর আহম্মেদ প্রমুখ জাতীয় নেতারা এসেছেন তার বাড়িতে। পার্টির ৫ম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন কমরেড মনসুর। কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও দীর্ঘদিন কৃষক সমিতি ঠাকুরগাঁও জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন কমরেড মনসুর। কমিউনিস্ট পার্টির পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে ৬নং পীরগঞ্জ ইউপি এর চেয়ারম্যান ইকরামুল হক ও ৮নং দৌলতপুর ইউপি এর চেয়্যারম্যান নিরোদ চন্দ্র ও বীরেন রায় নির্বাচীত হয়। এছাড়া প্রফুল্ল চন্দ্র, নুরুল আমিন, আব্দুল কাদের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে কাস্তে মার্কা নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করে তিনি এবং প্রতিবারেই সম্মানজনক ভোট পান। দীর্ঘদিন অসুস্থ্য থাকার পর আজীবন বিপ্লবী এই কমিউনিস্ট ২০১৯ সালের ১১ মে রাত ১০ টায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হেরে যান। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন ৫টি গণসংগঠনের উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে থাকা ৩০০ সদস্য ও কয়েকশ সহযোগী সদস্যের সমন্বয়ের শক্তিশালী এক পার্টি। ব্যক্তি জীবনে রেখে গেছেন পার্টির শুভাকাঙ্খী সহধর্মিনী স্ত্রী, পার্টির উপজেলা কমিটির নেতা প্রভাত সমীর শাহাজাহান আলম, সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও পার্র্টির সদস্য লেনিন এবং পার্টির শুভাকাঙ্খী ছোট ছেলে ব্রেজনেভকে।