ভিন দেশে ভাষা

ভ্রমণের সময় যে জিনিসটা মানুষকে সবচেয়ে অসহায় করে তোলে সেটা হচ্ছে ‘ভাষা’। বুঝলাম আপনি খুব স্মার্ট মানুষ, চরম উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন, চকচকে ব্যক্তিত্ব, কিন্তু যখন দক্ষিণ ফ্রান্সের কোন গ্রামে ঘুম ভাঙবে বা কিরঘিজিস্তানের পাহাড়ি মফস্বলে বা নিকারাগুয়ার সীমান্তে তখন ফরাসী, রাশান, স্প্যানিশ না জানার কারণে সামান্য নাস্তার অর্ডার দিতে গিয়েও প্রাণ আইঢাই করবে।

হ্যাঁ, বডি ল্যাংগুয়েজ বলে একটা জিনিস আছে বটে, এবং আছে বলেই আমরা ফাঁকিবাজরা বেঁচে গেছি, পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক হাত-চোখ-মুখের ইশারায় ঠিকই ভ্রমণ মোটামুটি সম্পন্ন করে বেরিয়ে আসতে পারি সকলেই, কিন্তু কী দারুণ হতো না ঐ দেশের ভাষা সামান্য পারলেও, কত শত লোকের সাথে বন্ধুত্ব হত, কত অজানা জিনিস জানতে পারতেন, এবং কত উটকো ঝামেলা এড়ানো যেত।এক আড্ডায় ভ্রমণ আগের চেয়ে এক কঠিন হয়ে গেছে, দেশে দেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া, ভিসার ঝামেলা এমন এক অভিযোগ তুলেছিলেন এক ভ্রমণপিপাসু, শুনেই আমাদের মেন্টর পাখিপ্রেমী ও ভূপর্যটক ইনাম আল হক হেঁসে বললেন,

“যে কোন সময়ের চেয়ে এখন ভ্রমণ করা সহজ, ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন, এই একশ বছর আগেই আপনি তিব্বতে গেলে বিদেশী গুপ্তচর সন্দেহে মেরেই ফেলতো, যারা গিয়েছেন অপরিসীম ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছেন। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা যে শুধু প্রাকৃতিক কারণেই দুর্গম ছিল তা নয়, মানুষের কারণেও ভ্রমণের অণুকুল ছিল না, অচেনা লোক দেখলেই সন্দেহ , আটক, অত্যাচার এগুলো ছিলই।”

সেই ছেলের আবার প্রশ্ন ‘কিন্তু আমাদের তো ট্যুরিষ্ট ভিসা দেয় না! পোল্যান্ড আর জার্মানি যাবার শখ ছিল’।

ইনাম ভাইয়ের উত্তর –” যে দেশের ঘুরতে যাবেন এত কষ্ট করে, সময় ব্যয় করে সেই দেশের ভাষা শিখেছেন? আপনি ৬ মাস, ১ বছর জার্মান, পোলিশ বা যে ভাষায় হোক ভালো মত শিখে যান দেখি ভিসার জন্য, ২০ মিনিট গড়গড় করে সেই দেশের ভাষায় কথা বললে কোন পাষাণ অফিসার আছে যে আপনাকে ভিসা দিবে না!” ( ইংরেজি বাদে অবশ্যই)

ভবঘুরে শিরোমণি রাহুল সাংকৃত্যায়ণ তাঁর ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’তে বারবার বলেছেন নানা ভাষা শেখার জন্য।

ভাষা নিয়ে বাংলাদেশীদের অবস্থা ইংরেজদের মতই করুণ, তাদের ধারণা যেহেতু ইংরেজি পৃথিবীর সবখানেই চলে তাহলে আর ভাষা জানার দরকার নেই, যদিও বায়োডাটায় লেখার সময় ভাষায় জায়গায় বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু লিখে কোটি লোক। সে যাক, কেউ সেভাবেই সুখী থাকলে থাকুক।

যারা আসলেই পৃথিবী নিজের মতো চষে বেড়াতে চান, বিলাসবহুল প্যাকেজে নয়, তাদের জন্য ভাষা শিক্ষাটা খুবই জরুরী, এবং কোন ভাষা শিখবেন এটা নির্ভর করছে কোন অঞ্চলে ভ্রমণে যাবেন তার উপরে । এখনের পৃথিবীতে ইংরেজি, স্প্যানিশ, রাশান, ফরাসী, আরবি আর চীন ঘুরতে চাইলে অল্প সল্প চাইনিজ জানলেই পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড আপনি বেশ আরামেই ঘুরে আসতে পারবেন একগাদা ঝলমলে স্মৃতিসহ।

এবারের মধ্য এশিয়ায় যেমন অল্প রাশান শব্দ ভাণ্ডার অবলম্বন করেই ৪ দেশে যে আনন্দ লাভ করেছি, পরের বার যাবার আগেই রাশান আরও অনেক বেশী শিখে তবেই যাব, এভাবে প্রস্তত হয়ে গেলে লাভ ১০০% আপনারই।জীবনে অবশ্য আরেকটি ভাষা ভালো মত শেখার মৃদু চেষ্টা করছি অনেক দিন ধরেই, স্প্যানিশ, নেরুদা সেই ভাষায় পড়ব বলে, রুবেন দারিও আর মার্কেজের শব্দজাদুতে হারানোর জন্য স্প্যানিশ জানা অতি আবশ্যক, আর সেই সাথে এই ভাষাটা খুব সুরেলা লাগে, ঝগড়া করলেও মনে হয় অপেরার সোপরানোরা গাইছে! আগামি কমাস যে দেশগুলোতে ঘুর ঘুর হবে সবার ভাষায় স্প্যানিশ ( আদিবাসীদের বাদে অবশ্যই) , এখনই সময় ভাষাটাকে আরো নিবিড় ভাবে শেখার।

নতুন ভাষা শিখতে পিছপা হবেন না, ভয় পাবেন না। চেষ্টা করুন, যতটুকুই শিখুন ১০০% লাভ আপনার নিজের।