মানুষ একদিন প্রকৃতি জয়ের নেশায় মত্ত হয়েছিল। প্রকৃতিকে জয় করতে পারলেও অবসান হলো না সে নেশার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তার শুরু করল। মানুষের এই বিজয় রথ মানুষকে এক ভয়ঙ্কর গভীর সংকটে ফেলে দিল। এ সংকট বিশেষ কোনও দেশের নয়, নয় বিশেষ কোনও জাতির। এ সংকট এককভাবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির।
পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবনীশক্তির বাহক। পরিবেশের ওপর নির্ভর করেই বিকাশ ঘটে মানুষ, অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের । সৃষ্টির আদি থেকেই পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপরেই নির্ভর করছে প্রাণ ও প্রকৃতির অস্তিত্ব। পরিবেশ প্রতিকূল হলে জীবের ধ্বংস ও বিনাশ অনিবার্য । তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ পরিবেশকে আমরা মানুষেরাই নানাভাবে বিষিয়ে তুলেছি, দূষিত করে আসছি। বিশ্বজুড়ে এখন পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ। উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। পরিবেশদূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত, চরম হুমকির মুখে, যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা।
ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কবলে পড়ে আজ শঙ্কায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। জলে স্থলে আকাশে বাতাসে আজ আতঙ্ক। গত ৬০ বছরে ৮০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়েছে কয়েকশ প্রজাতির গাছপালা।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। এ পরিণামে বাতাসে প্রতিবছর ২২ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড সঞ্চিত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের আনুপাতিক হার ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে বৃষ্টির জলে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। এই অ্যাসিড বর্ষণ অরণ্যে মহামারীর সৃষ্টি করছে। খাদ্যশস্যকে বিষাক্ত করছে। দ্রুতগতিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ অরণ্য। সারা বিশ্বে বর্তমান ৮০ শতাংশ হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্য। এর মধ্যে প্রতি মিনিটে ২১ হেক্টর কৃষিযোগ্য জমি বন্ধ্যা হয়ে গেছে। প্রতিবছর ৭৫ লাখ হেক্টর জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে।
প্রতি মিনিটে ৫০ হেক্টর উর্বর জমি বালুকাকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বাতাসে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন কমছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে ভূপ্রকৃতির ওপর অত্যাচার বাড়ছেই। শস্য রক্ষার জন্য নানা ধরনের কীটনাশক ওষুধ তৈরি ও প্রয়োগ হচ্ছে। এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঘটছে মানুষের শরীরে। ফলে নানা জটিল ও কঠিন রোগের দানা বাঁধছে আমাদের শরীরে।
পরিবেশদূষণের জন্য পৃথিবীতে ৮০ শতাংশ নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশদূষণের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানিতে পরিণত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের আয়তন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে সূর্যের মারাত্মক অতিবেগুনি রশ্মি প্রাণিজগৎকে স্পর্শ করবে।
এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুইডেনের স্টকহোমে ৫ জুন থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর দু’বছর পরে, ১৯৭৪ সালে ‘একমাত্র পৃথিবী’ (Only One Earth) এই থিম নিয়ে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়েছিল সামুদ্রিক দূষণ, জনসংখ্যা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বন্যপ্রাণের মতো পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। তখন থেকে বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ নিয়ে জাতিসংঘ ৫ জুনকে ঘোষণা করেছে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে, যা প্রতিবছর ১৫০টি’র অধিক দেশে পালিত হয়ে আসছে।
পুরো বিশ্বই আজ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে পদানত। গতানুগতিক জীবন ধারা পাল্টে এক নতুন স্বাভাবিক জীবনের অপেক্ষায় মানুষ। বিশ্বব্যাপী মহামারী কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড় সংকটের বিষয়কে সামনে রেখে এবার ৪৮তম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করতে যাচ্ছি, যার মূল প্রতিপাদ্য ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা’ (Ecosystem Restoration) ।
নিজের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই প্রকৃতি এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাস্তুতন্ত্রে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে খাদ্য, জল ও খনিজ দ্রব্যাদির জোগান ঠিক রাখে জীববৈচিত্র্য, তাকে ধ্বংস করা যাবে না। পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তন, দূষণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গাছপালা নিধন না করে বেশি বেশি গাছ লাগানো থেকে শুরু করে প্রকৃতিকে শান্ত করতে যা যা করণীয়, সবই করতে হবে।
শিল্পোন্নত শীর্ষদেশগুলো এখনও পর্যন্ত কার্যকর প্রতিশ্রুতি না দেওয়ায় ঝুঁকি না কমে বরং বেড়েছে। কার্বন ঢেলে দেওয়া শীর্ষ দেশগুলো যদি মানবিক না হয়, যদি আন্তরিকতার সাথে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তাহলে এ পৃথিবী ক্রমশই উত্তপ্ত হতে থাকবে। বিপন্ন হতে থাকবে প্রাণীকূলের অস্তিত্ব। এখনো পর্যন্ত যেসব প্রাণী টিকে আছে, তারাও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের মতো বিপন্ন হতে হতে একসময় বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হবে । সৌরজগতের একমাত্র প্রাণের আঁধার এ ধরিত্রী, নির্জীব প্রাণহীন গ্রহে পরিনত হবে। মানবিক বোধ জাগ্রত হোক সবার, শীতল হোক ধরিত্রী। পূর্ণপ্রাণে বিকশিত হোক এ পৃথিবীর প্রাণী, পরিবেশ, মানুষ।