ডিজিটাল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার গ্রাম, শহর, বন্দর বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করলেও ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরচুনা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী খেকিডাঙ্গী গ্রামের শিশুদের এখনও পড়াশুনা করতে হচ্ছে কেরোসিনের চেরাগ কিংবা হারিকেনের আলোয়। ওই একই আলোতে সারতে হয় গৃহস্থালি সহ সংসারের সব কাজ। পিছিয়ে পড়া ওই গ্রামটির মানুষের কাছে বিদ্যুৎ যেন সোনার হরিণ। এ সোনার হরিণ পেতে দীর্ঘ দিন ধরে ছুটছেন তারা। একবার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলেও একটি মহলের কলকাঠিতে তা সফল হয়নি। পথেই আটকা পড়ে। আসতে দেওয়া হয়নি ওই গ্রামে। বিদ্যুৎ বিহীন গ্রামটির সাধারণ মানুষদের নানা প্রতিকুল পরিবেশের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে দিন পার করতে হচ্ছে।
পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে গ্রামটির দুরত্ব প্রায় ২৫ কিঃমিঃ। সীমান্তবর্তী ঘেষা অবহেলিত এ গ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা সহ প্রায় এক’শ পরিবার বাস করে। ছোট খাট ব্যবসা এবং দিন মুজুরী করেই চলে সংসার চালায় গ্রামের লোকজন। বেশির ভাগ মানুষের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। গ্রামে কোন বিদ্যালয় নাই। প্রায় দেড় কিলোমিটার দুরে জগন্নাথপুর বাজারের বিদ্যায়য়ে যেতে হয় এখানকার শিশু কিশোরদের। দিনের বেলায় সুর্য্যের আলোতে তারা পড়া লেখা করতে পারলেও রাতে কেরোসিনের চেরাগ কিংবা হারিকেনই একমাত্র ভরসা। তবে দু’এক জনের বাড়িতে সোলারও রয়েছে। তাদের শিশুরা সোলারের বাতিতে পাড়া লেখা করলেও বেশির ভাগের ভাগ্যে তা জুটে না। বেশির ভাগ পরিবারের পড়া লেখা করার মত তেমন কোন পরিবেশ নেই। নেই কোন চেয়ার টেবিল বা শিক্ষক। বারান্দায় সিমেন্টের পরিত্যক্ত বস্তা বিছিয়ে পড়তে বসে কোমলমতি শিশুরা। বেশির ভাগ পরিবারের অভিভাবক পড়াশুনা জানে না। শিক্ষক রাখার মত সামথ্যও নেই তাদের। এ অবস্থায় শিশুরা স্কুলে যা পড়ে তা তারা বাড়িতে নিজেরাই নিজের মত করে পড়ার চেষ্টা করে। ঠেকে গেলে শিখিয়ে বা দেখিয়ে নেয়ার মত কেউ থাকে না।
খেকিডাঙ্গী গ্রামের জামাল জানান, এ গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় সবাইকে অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে। সন্ধা নামলেই সেখানে নানা ধরণের সমস্যায় পড়েন তারা। ছেলে মেয়েরা ঠিকমত পড়াশুনা করতে পারে না। রাতের বেলা হারিকেন কিংবা কুপি (চেরাগ) দিয়ে তাদের সব কাজ সারতে হয়। কোন দিন কেরোসিন তেল না থাকলে সেদিন বাচ্চাদের লেখা-পড়া বন্ধ থাকে। এ গ্রামে কোন মানুষ বিয়ে সাদি দিতে বা করাতে চায় না অন্য এলাকার মানুষ। বিদ্যুৎ নিয়ে এখানকার নব দম্পতিদের মাধ্যে প্রায় ঝগড়া ঝাটি হচ্ছে। শুধু তাই না বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সব ধরণের আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
বেগম নামে তৃতীয় শ্রেনির এক শিক্ষার্থী জানায়, একটা চেরাগ দিয়ে তিন চার জনকে পড়তে হয়। ঠিকমত দেখা যায়। রাতে পড়া পড়তে তাদের খুব কষ্ঠ হয়।
গ্রামবাসিরা জানান, অনেক ঘুড়াঘুড়ির পর গ্রামের প্রায় এক’শ পরিবারে বিদ্যুৎ দিতে ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ লাইন নির্মান করার বরাদ্দ করান। ২০২০ সালে মাঠ জরিপ ও নকশার প্রনয়ন করে লাইন নির্মানের টেন্ডার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করে ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। জনৈক লুৎফর রহমান নামে এক ঠিকাদার লাইন নির্মানের কার্যাদেশ পান। লাইন নির্মানের জন্য ১৮টি সিমেন্টের খুঁটি এনে ঐ গ্রামে ফেলেন ঠিকাদার লুৎফর। ৫টি খুঁটি গাড়ার পর একটি বহুজাতিক কোম্পানীর স্থানীয় কয়েকজন বাধা দেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় লাইন নির্মান কাজ। বাকি খুঁটিগুলি ফেলে রেখে চলে যান ঠিকাদার। এর পর আর ঠিকাদার সেখানে যাননি।
ঐ গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক জানান, “প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, ঘড়ে ঘড়ে বিদ্যুৎ” এ শ্লোগান এখানে কাজে আসছে না। আমি দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ করেছি। দেশে আজ এত উন্নয়ন। অথচ আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ নাই। আমিও ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করেছি কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। খুটি গুলি অবহেলা অযতেœ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পীরগঞ্জ জোনাল অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক বাচ্চু মিয়া বলেন, আমি শুনেছি বাধার কারণে উপরের নির্দেশে সেখানে লাইন নির্মান কাজ বন্ধ হয়েছে। নির্দেশনা পেলে কাজ করা হবে।