
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে “জয়িতা অণে¦ষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ঠাকুরগাঁয়ের পীরগঞ্জে চার জন নারীকে শ্রেষ্ঠ জয়ীতা হিসেবে নির্বাচন করেছেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। তারা হলেন-
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী মোছাঃ লিলুফা ইয়াসমিন: মোছাঃ লিলুফা ইয়াসমিন, স্বামী: মৃত তোজাম্মেল হক, মাতা: মোছা: মসলেমা খাতুন, জগথা, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও। তিনি ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিয়ে করেন। তার একটি মেয়ে সন্তান আছে। স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। তার স্বামী হঠাৎ করে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে ফলে আর্থিক অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ২৭ শে আগস্ট তার স্বামী ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তখন তিনি টিউশনি করে দুটি গরু ক্রয় করেছিলেন। সেই গরু বিক্রি করে এবং উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় হতে ক্ষুদ্রঋণ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিআরডিবি থেকে ঋণ নিয়ে টি.এস লেডিস টেইলার্স এন্ড ক্লথ স্টোর এর সূচনা করেন। বর্তমানে তার দোকানে ৩-৪ জন কারিগর কাজ করেন। তিনি কারিগরদেরকে বেতন এবং আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মাসে প্রায় ৩০,০০০/- টাকা আয় করেন।
সফল জননী মোছাঃ রোকেয়া বেগম:
মোছাঃ রোকেয়া বেগম, পিতা: আব্দুল হালিম, মাতা: জবেদা খাতুন, গ্রাম: খামার নারায়নপুর, ডাকঘর: মালগাঁও, উপজেলা: পীরগঞ্জ, জেলা: ঠাকুরগাঁও, স্বামী: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার ৪ (চার) সন্তান। দারিদ্রতা দিয়ে জীবনের শুরু। স্বামী স্কুল শিক্ষক হলেও জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন। সামান্য জমি ও স্বল্প বেতনে সংসার পরিচালনায় বেশ কষ্ট হতো। নিজে ধান ভানা, হাঁস মুরগী পালন, গরু পালন এবং সবজীর চাষাবাদ করে সংসারে সাহায্য করেছেন। তিনি ভীষন দারিদ্রতার মধ্যে সন্তানদের লালন পালন করেছেন। তাঁর প্রথম সন্তান এসএম রফিকুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএ পাশ করে বর্তমানে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও এ কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় সন্তান মোঃ ফেরদৌস রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করে বর্তমানে ডিএন ডিগ্রী কলেজের ইংরেজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তৃতীয় সন্তান মোঃ তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএ পাশ করে বর্তমানে রুপালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত। চতুর্থ সন্তান মোছাঃ দৌলতুনাহার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে বর্তমানে ডিএন ডিগ্রী কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন মোছাঃ সারমিন আকতার:
মোছাঃ সারমিন আকতার, স্বামীঃ মোঃ কামাল হোসেন, বথপালিগাঁও, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও। তিনি অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৬ ভাইবোনের মধ্যে মোছাঃ সারমিন আক্তার ৫ম। তিনি এসএসসি, এইচএসসি ও বিএসএস পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তাকে এমএসসি পাশ করার পরেই পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ে করবেন না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে বোনের বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা করেন। চাকুরী খুঁজতে গিয়ে এক পর্যায়ে আরডিআরএস বাংলাদেশ এ মাইক্রোফিনেন্স অফিসার পদে চাকুরী হয়। মোঃ কামাল হোসেন এর সাথে ২০১০ সালে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি বাচ্চা জন্ম নেয় এবং নির্ধারিত ছুটির মধ্যে চাকুরীতে যোগদান না করায় তাকে চাকুরী থেকে অপসারন করা হয়। একদিকে তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি সন্তানদের জন্য অপরদিকে চাকুরী হারানোর ফলে পরিবারে শুরু হয় তার মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন। এক পর্যায়ে সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে একদিন সারমিন তার মেয়ে সন্তানকে নিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে বলে সিন্ধান্ত নেয়। মেয়েটির মুখের দিয়ে তাকিয়ে ঘরের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে প্রায় ১ ঘন্টা পড়ে থাকে। ঘটনার পর সারমিন শক্ত মনে উঠে দাড়ায় এবং সিন্ধান্ত নেয় যে, আর বাবার বাড়ি যাবে না প্রতিবাদ করে স্বামীর বাড়িতেই থাকবেন। একসময় পল্লীশ্রীর মাঠ-সংগঠক পদে আবার তার চাকুরী হয় এবং ২য় একটি সুস্থ মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে তিনি স্কুটি চালিয়ে পল্লী¤্রীতে চাকুরী করছেন। তার পরিবারে সাথে তিনি এখন ভালো আছেন।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন ঊষা রানী রায়:
ঊষা রানী রায়, পিতা: কিরণ চন্দ্র বর্মণ মাতা: বিরদা রানী রায়, ভাদুয়া, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও। তিনি একজন সাধারণ গৃহিনী। তার মাত্র ২০ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। গ্রামের কিছু মহিলাদেরকে নিয়ে প্রথমে ১৫ জনের একটি সংগঠন তৈরি করেন। সংগঠনের সবাই ১০ টাকা সঞ্চয় জমা করা শুরু করেন এবং প্রতি সপ্তাহেই মিটিং করেন। মিটিং এ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, শিশুশ্রম নিরসন, গর্ভবতী মা ও শিশুর যতœ এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে আলোচনা করেন। সেই ১৫ জনের সংগঠন এখন ৫০ জনে উন্নীত হয়েছে। ঊষা রানী নিজের উদ্যোগে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, শিশুশ্রম নিরসন, গর্ভবতী মা ও শিশুর যতœ এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে পাড়ায় পাড়ায় উঠান বৈঠক এবং আলোচনা সভা করছেন। এতে করে অত্র ইউনিয়নে বাল্য বিবাহ ও নারী ও শিশু নির্যাতন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও ঊষা রানী নিজের উদ্যোগে চুলের কেপ, নকশী কাঁথা তৈরি, পুঁথির কাজসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আসে দরিদ্র পরিবারের কিশোরীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তথ্য : পীরগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়।